সাল ২০১২, ‘হেমলক সোসাইটি’ বানিয়েছিলেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। ছবিটি দাগ কেটেছিল সিনে প্রেমীদের মনে। তারপর পার হয়েছে অনেকগুলো বছর। আর এবার 'কিলবিল সোসাইটি' নিয়ে ফিরছেন সৃজিত। নায়কের ভূমিকায় সেই পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ছবি মুক্তির আগে নানান বিষয় নিয়ে Hindustan Times Bangla-র সঙ্গে খোলামেলা আড্ডা দিলেন পরমব্রত।
‘কিলবিল সোসাইটি’ ছবিটি 'হেমলক সোসাসাইটি'র সিক্যুয়েল, তারপরেও নামে কেন বদল?
পরমব্রত: গত ১৩ বছরে পৃথিবীতে অনেককিছু বদলে গেছে। আনন্দ করও বদলেছে। যে কাজটা আনন্দ করত, সে নিজেই বলছে, সে কাজটা এখন আর করে না। এমনকি তার নামেও একটা বদল ঘটেছে। সে এখন একটা ভাড়া করা খুনি। সে খুন করে, মানে Kill করে করে Bill raised করে। সেজন্যই এখন এর নাম এবার ‘কিলবিল সোসাইটি’।
আনন্দ কর এখন মৃত্যুঞ্জয় কর হয়েছেন, তাহলে ভাবনা চিন্তার এই পরিবর্তনের কারণেই….
পরমব্রত: হ্যাঁ, মৃত্যুঞ্জয়, মৃত্যুকে যে এনজয় করে, এই ভাবনা থেকেই এমন নামটা বেছে নেওয়া হয়েছে।
ছবির জন্য ন্য়াড়া হয়েছেন, আপনাদের তো একসঙ্গে অনেক কাজ থাকে, শ্যুটিং থাকে, এতে কোনও সমস্যা হয়নি?
পরমব্রত: না সৃজিত এটা শুরুতেই বলে দিয়েছিল। আমি জেনেবুঝেই রাজি হয়েছি। বাকিটা সামলানো আমার কাজ ছিল। কারণ আমি জেনেই রাজি হয়েছি। তাই ফেরার কোনও চান্স নেই। আমার মনে হয়েছিল এটার জন্য আমি ন্যাড়া হতে পারি।
ছবিতে কৌশানির ব্যক্তিগত ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে, আজকাল প্রায়ই এমন ঘটনা শোনা যায়, বিষয়টা কতটা বিপদজনক হয়ে উঠছে?
পরমব্রত: Exactly, আগে যখন হেমলক তৈরি হয়েছিল, তখন এই বিষয়টাকে MMS স্ক্যান্ডেল বলা হত। সেটা তখন অনেক rare ছিল। এখন আর এমএমএস করতে হয় না। ব্য়াপারটা এখন অনেক সহজ। কারোর ব্যক্তিগত ভিডিয়ো, হোয়াটসআপ চ্যাট ছড়ানোর বিষয়টা এখন জলভাত। এটা দিনকে দিন আরও বিপদজনক হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে কোনও কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকছে না। মানুষ আসলে কোনও কিছুই আর ব্যক্তিগত রাখছেন না।
আজকাল অনেকেই সকালবেলা উঠে ইঁদুর দৌড়ে নেমে পড়েন, কে কত আগে কত কী শেয়ার করতে পারেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। এর মধ্যে কেউ যদি প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে মনে করেন কারোর ব্য়ক্তিগত কিছু ছড়িয়ে দেবেন, এটা আজকাল কোনও ব্যাপারই নয়। এটা নিঃসন্দেহে দিনে দিনে বিপদের পথেই ঠেলে দিচ্ছে।
সেলিব্রিটিদের তো সোশ্য়াল মিজিয়া নিত্যদিনের সঙ্গী…। যদিও আপনাকে সেভাবে দেখা যায় না…।
পরমব্রত: আমি আসলে কোনওদিনই খুব বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকি না। কেননা আমি ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যক্তিগত রাখতেই ভালোবাসি। তবে শুধু ব্যক্তিগত বিষয়ের জন্য নয়, সোশ্যাল মিডিয়া আজকাল উপার্জনেরও নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে। এই যে রিল বানানো, এটা যে শুধু অনেকে নিজের বা ছবির প্রচারের জন্য করে, তা না। বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার করে। সেটা অবশ্য আমিও করি। বিশেষ করে কোনও উৎসবের সময়, পুজো-ক্রিসমাস-ইদ, বিভিন্ন জিনিসের বিজ্ঞাপনের জন্য আমিও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি।
বিজ্ঞাপনও তো বদলে গেছে…।
পরমব্রত: হ্য়াঁ, বিজ্ঞাপনের পরিভাষাটাই বদলে গিয়েছে। আগে বিজ্ঞাপন বলতে আমরা বুঝতাম বড় করে শ্যুটিং হবে, বা ফটোশ্যুট হবে, এখন সিংহভাগটাই দখল করেছে সোশ্য়াল মিডিয়া। নির্দিষ্ট প্রোডাক্টের রিল বানালেই কাজটা হয়ে যায়। প্রযুক্তি বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন। তাই পেশাগত কারণে এটা লাগে আমি ব্যবহার করি। আমার সোশ্যাল মিডিয়া হ্য়ান্ডেল করে একটি সংস্থা। সেখানে আমি যদি ব্যক্তিগত কিছু দিতে চাই সেটুকুই দিই।
এই যেমন দু'দিন আগেই পিয়া আর আমার একটা গান দিয়েছিলাম। অনেকেই সেটা দেখেছেন, ভালো লেগেছে বলেছেন। তবে ওই টুকুই। তবে সকালে উঠে আমি কতবার বাথরুমে গেলাম, কোন বন্ধুকে মিট করলাম, কী কী কথা বললাম, এসব থেকে দিই না। আমার মনে হয়না, সোশ্যাল মিডিয়া এগুলোর সঠিক জায়গা।
AI আসার পর আরও অনেক কিছুই ঘটছে, অনেক সময় এমন কিছু দেখছি যে সত্যি মিথ্যে আজকাল বোঝা দায়…।
পরমব্রত: এটার ভালো দিক আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। AI বিষয়টা অবশ্য ভালো, এটাকে দারুণ করে কাজে লাগানো যায়। যেকোনও প্রযুক্তির একটা ভালো দিক, খারাপ দিক দুটোই থাকে।
ওপেন হাইমার যেমন অ্যাটোমিক থিওরির উপর গোটা ভাবনাটা তৈরি করেছিলেন, সেটা তো উনি বোমা বানানোর জন্য তৈরি করেননি। ওটা ওঁর বৈজ্ঞানিক রিসার্চ ছিল। সেটাই কাজে লাগিয়ে প্রাণঘাতি ভয়ানক নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি হয়। এই বিষয়টাও ঠিক তেমন।
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন তো আর থেমে থাকবে না, সেটা চলতেই থাকবে। সেটাকে মানুষ কীভাবে কাজে লাগাবে, সেটা মানুষের উপর নির্ভর করে। এখন এটা সৃষ্টির থেকে অনেক বেশি ধ্বংসের কাজেই লাগানো হয়।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির নিজেকে মারার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করেছিলেন। এমন কাণ্ড করা সত্যিই কি এদেশেও সম্ভব?
পরমব্রত: অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ওদেশে করেছিলেন বলে, এদেশে এটা হবে না এমনটাও নয়। আমরা আসলে এদেশ আর ওদেশের মধ্যে পার্থক্যটা বেশিই ভাবি। আসলে অতটা পার্থক্যও নয়। ফাইনালি সকলেই মানুষ। ওনার মতো পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এখানকার কোনও মানুষ এমন করতেন কিনা, সেটা বলা মুশকিল! পৃথিবীতে যেহেতু ঘটেছে, তাই সেটারই রেফারেন্স নিয়েছে সৃজিত, এটা এদেশে ঘটাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টাও কি চলে আসে না?
পরমব্রত: মানসিক স্বাস্থ্য এখন সত্যিই একটা আলোচ্য বিষয়। আবার বিতর্কিতও বটে। সোশ্যাল মিডিয়ার একটা ভালোদিক হল, এখন অনেক জিনিস নিয়ে আলোচনা হয়। যেগুলো নিয়ে আলোচনা আগে হত না। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে ১০ বছর আগে আমরা ভাবতাম, বাবা ও তো পাগল হয়ে গেছে, বা ডাক্তার না দেখাতে চাওয়া, এগুলো ছিল। এখন কিন্তু আসতে আসতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। মানুষ এটা নিয়ে কথা বলছেন। এই সচেতনতা আনার চেষ্টা হচ্ছে, এটা অন্য স্বাস্থ্যের মতোই একটা জিনিস। আমাদের পেট খারাপ করলে যেমন ডাক্তারের কাছে যাই, তেমনই মনের সমস্যা হলেও আমরা ডাক্তারের কাছে যাব। সেই প্রেক্ষাপটে আমাদের ছবির নায়িকা এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
১৩ বছরে আর কী কী বদলেছে বলে মনে হয়?
পরমব্রত: মানুষের মধ্যে ট্যাবু এখনও আছে। তবে আলোচনা আগে হত না, এখন সেটা হয়। তবে এটাও ঠিক গত কয়েক বছরে মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার উপাদান বেড়েছে। আমরা ১৩ বছর আগে অনেক কিছুই ভাবতে পারতাম না করতে পারতাম না। এখন সেটা কিন্তু করতে পারি। ১৩ বছর আগেও রাজনীতিতে মানুষ দল বদল করত। তবে এখন যত তাড়াতাড়ি, যত স্বচ্ছন্দে মানুষ এটা করে, ১৩ বছর আগে হয়ত এত সহজ ছিল না। মানুষ যে ভাষায় সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণ করেন, ১৩ বছর আগে সেটা মানুষ ভাবতেও পারতেন না। ১৩ বছর আগেও যুদ্ধ হয়েছে, আর এখন যুদ্ধের নামে গোটা অঞ্চলকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটা আগে কই দেখিনি। সবই বদলে যাচ্ছে। খুব তীব্র হচ্ছে। চারপাশে এতকিছু, যার অধিকাংশই খারাপ। তাতে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
হেমলকে ছিলেন কোয়েল। আর কিলবিল-এ কৌশানি অভিনেত্রী হিসাবে কাকে এগিয়ে রাখবেন?
পরমব্রত: কোয়েল যখন হেমলক সোসাইটি করেছেন তখন তিনি বাণিজ্যিক বাংলা ছবির সুপারস্টার। আর কৌশানি যখন কিলবিল সোসাইটি করছেন, তখন বাণিজ্যিক বাংলা ছবির বিষয়টাই একপ্রকার মৃতপ্রায়। এখন বাণিজ্যিক বাংলা ছবিকে বাঁচিয়ে তোলার আবারও চেষ্টা শুরু হয়েছে, অন্য পরিভাষায়। তবে ২০১১ সালের শেষে যখন আমরা হেমলক শ্যুট করেছিলাম, তখন সেই প্রয়োজন পড়েনি। কারণ তখন বা তার আগে বাণিজ্যিক বাংলা ছবি রমরম করে চলত। যখন কোয়েলের সঙ্গে শ্যুট করছি, তখন ওর ‘১০০ পারসেন্ট লাভ’ বলে একটা ভীষণ সফল ছবি রিলিজ করেছিল। যেটা ব্লকবাস্টার।'
আর কৌশানিকে আমরা অভিনেত্রী হিসাবে আবিষ্কার করেছি, গত ২ বছর হল। ‘আবার প্রলয়’ থেকে। তার আগে পর্যন্ত জানতাম ও একটা সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসা মেয়ে, সোনার দোকানে বিজ্ঞাপন করত, আর এখন ছবি করে। ও যা কাজ করেছিল, এর আগে ততটা উল্লেখযোগ্য ছিল না। তবে কৌশানি যখন এই কাজটা করল, তখন ও নিজেকে অভিনেত্রী হিসাবে পুনরাবিষ্কার করার চেষ্টা করছে। জাস্ট যাত্রাটা শুরু করেছে।
তবে কোয়েলের সঙ্গে যখন কাজ করেছি, তখন ও আমার থেকে ৫গুণ বড় স্টার। এই দুটো জায়গা থেকে পার্থক্য হবেই। তবে কোয়েলও অন্যরকম কিছু করতে চেয়েছিল বলেই হেমলক করেছিল। আর কৌশানি নিজেকে অভিনেত্রী হিসাবে আরও প্রতিষ্ঠিত করতে কিলবিল করেছে। দুজনেই সেরাটা দিয়েছে।
কৌশানির সঙ্গে একটা চুম্বন দৃশ্য রয়েছে, যার কারণে আপনাকে ফের ইমরান হাশমি বলা হচ্ছে। কী বলবেন?
পরমব্রত: এটা আর নতুন কী! (হাসি) এটা লোকজন মজা করে বলেন। এতে কোন সমস্যা নেই। আমি একজন অভিনেতা হিসাবে বিশ্বাস করি, প্রত্যেকের একটা নিজস্ব সীমারেখা থাকে, যে সে কতটা কী করতে স্বচ্ছন্দ। প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দ থাকে। তবে আমি যখন অভিনেতা তখন চরিত্রের প্রয়োজনে আমি এটা করতে তৈরি। কারণ চুম্বন ভালোবাসার একটা বহিঃপ্রকাশ। তাই অভিনেতা হিসাবে কোনও ছুৎমার্গ থাকা উচিত নয় বলে আমার মনে হয়। তবে এটা আমার ভাবনা, অন্যেরও একই ভাবনা হবে তার মানে নেই। প্রত্যেকের ভাবনাকে আমি সম্মান করি।
আমাকে অনেক ছবিতেই এমন দৃশ্যে দেখা গিয়েছে। তবে পরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, যে আমার বিপরীতে যিনি আছেন তিনিও রাজি। কারণ, চুমু তো আর একা খাওয়া যায় না। অপরপক্ষের সম্মতিতেই শ্যুট করেছি। পরিবেশটাও সেভাবে তৈরি করা হয়েছিল।
এবার একটু ব্যক্তিগত বিষয়ে আসি, জীবনটা বদলেছে। এই সময়টা স্ত্রী পিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে কীভাবে কাটাচ্ছেন? উপভোগ করছেন?
কাজ ও সংসার ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছি। যেটা আমার মতো মানুষের জন্য ভীষণ কঠিন একটা কাজ। কারণ আমি একসঙ্গে একাধিক জিনিস করি। আমার মতো একটা মানুষের জন্য সেটা খুবই কঠিন। তবে চেষ্টা করছি ব্যলেন্স করার। আগামী দিনে আরও বেশি করে ব্যলেন্স করার চেষ্টা করব। পরিবারের জন্য আরও সময় করব, এমনই ইচ্ছে আছে।